আনন্দের ট্রেন আফসোসের ট্রেন

Passenger Voice    |    ১১:২৮ এএম, ২০২০-০৯-১১


আনন্দের ট্রেন আফসোসের ট্রেন

মোস্তফা মামুন: আচ্ছা, কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন এত দূরে রাখা হয় কেন? করোনাকালে বিধি-নিষেধের সীমানা বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি থেকে নামতে হয় মূল গেটের বাইরে। সেখান থেকে ট্রেন পর্যন্ত যেতে বয়স্ক মানুষের শ্বাসকষ্ট হওয়ারই কথা। হয়ও নিশ্চয়। কিন্তু ‘এই সামান্য’ বিষয় নিয়ে কেউ আর খুব অভিযোগ করে না। বড় বড় বিষয়ের বড় বড় ধাক্কা খেয়ে মানুষের মেনে নেওয়ার ক্ষমতা এমন বেড়ে গেছে যে ধরে নেয়, এ সবই ললাটলিখন। বদলানোর নয় যখন, তখন আর কথা বলে শক্তিক্ষয় কেন?

বহুদিন পর ট্রেনে চড়লাম। করোনাকালে রেলওয়ের পারফরম্যান্স কিন্তু অসাধারণ। লঞ্চ-বাস যখন স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করেনি, ইচ্ছামতো টিকিট বিক্রি করেছে, তখন ট্রেন নিয়ম মেনে চলে অক্ষরে অক্ষরে। আর তাতে যাত্রীদের একেবারে পোয়াবারো। পাশের সিট খালি থাকছে বলে একটা টিকিট আসলে দুটি টিকিট। তিনটা টিকিটে একটা ছয় সিটের ডাবল কেবিন মিলে গেল, যাকে বলে দারুণ আরামদায়ক পরিবেশ। তা ছাড়া চাপ নেই বলে টাইমটেবিলও পুরো ঠিক। কাগজ-কলমে যে সময়ের কথা বলা থাকে, সেই সময়েই যে ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছবে—এটা করোনাকালে ট্রেনে না চড়লে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। এই সময়নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা দেখে ইউরোপের ট্রেনভ্রমণের অভিজ্ঞতা মনে পড়ল। পড়াশোনাসূত্রে আমার স্ত্রী নরওয়ের অসলোতে ছিল বেশ কয়েক বছর। বেড়াতে গিয়ে দেখলাম, হোস্টেল থেকে সে ঘড়ি দেখে ঠিক ৭টা ১৭ মিনিটে বেরোয়। কারণ? ‘হোস্টেল থেকে হেঁটে স্টেশনে যেতে ৫ মিনিট, তাতে ৭টা ২৩ মিনিটে ট্রেনটা ধরা যাবে। ৭টা স্টেশন পাড়ি দিতে মোট সময় লাগবে ২৮ মিনিট, ৭টা ৫১-তে পৌঁছে যাব। এরপর হেঁটে ৫ মিনিটে ক্যাম্পাস। ৮টার ক্লাস ধরতে কোনো সমস্যা নেই।’

সত্যিই সমস্যা হয় না। নিজেও কয়েক দিন সঙ্গী হয়ে দেখলাম, সেই ৭টা ২৩, সেই ২৮ মিনিট।

আফসোস হলো। টাইমটেবিল-সংক্রান্ত একটা গল্পও মনে পড়ল সুদূর শীতের দেশে।

ট্রেন সময়মতো না আসা, দেরি করায় যাত্রীরা খেপে গিয়ে স্টেশন মাস্টারকে ঘেরাও করল।

‘আপনারা পেয়েছেনটা কী? গাড়ি সময়মতো আসে না। আমাদের ভোগান্তি।’

‘আমি কী করতে পারি। ট্রেন তো আর আমি চালাই না।’

একজন ব্যঙ্গের স্বরে বললেন, ‘আপনি ট্রেন চালাতে না পারলে তো এই টাইমটেবিল শিডিউলটা পুড়িয়ে ফেলতে পারেন। ওটা তো কোনো কাজে আসে না।’

স্টেশন মাস্টার হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওটা পোড়াবেন না। ওটা পোড়ালে তো আর বুঝতে পারবেন না ট্রেন সময়মতো আসছে কি না?’

এটাও যৌক্তিক কথা। যাত্রীরা হতবুদ্ধি।

এটা গল্প। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা এই গল্পের মতো নয়, করোনাকাল বাদ দিলে সময়সূচিও অনেক ভালো। ভাড়াও সহনীয়। বাস যখন ভাড়া বাড়িয়ে বাড়িয়ে আকাশে উঠে প্লেনের সঙ্গে লড়াই করতে চাচ্ছে, তখন ট্রেনের টিকিটের দাম খুবই বাস্তবসম্মত। এর চেয়েও বড় জায়গা হলো নিরাপত্তা। বাংলাদেশে শেষ কবে বড় রেল দুর্ঘটনা হয়েছে জানতে ইতিহাসবিদের কাছে যেতে হবে। এত এত সুবিধা সাজিয়ে নিয়ে বসে যে রেল, আশ্চর্য ব্যাপার, তুচ্ছ কিছু অসংগতিতে তার প্রাপ্য পায় না। পায় না, নাকি পেতে দেওয়া হয় না! শুনতে পাই, বাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মানুষেরা চান না বলে ট্রেনের উন্নয়ন হয় না। বাস-ট্রাকের সঙ্গে অনেক রুই-কাতলা জড়িয়ে, সঙ্গে সড়ক তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণেও কোটি কোটি টাকার ব্যবসা, তাদের স্বার্থেই ট্রেনটাকে অকেজো করে রাখার চেষ্টা চলে।

অনেক বছর আগে একবার ট্রেনে যাচ্ছি। শোভন কামরা। এক যাত্রী একটু পর পর সবাইকে শোনাচ্ছেন, ‘উফ! এখানে দেখি ঠিক বসাই যায় না। সিটগুলো তো যাচ্ছেতাই।’

‘দূর, ফ্যানটা তো চলছেই না।’

‘না, মশারও দেখি খুব উপদ্রব। এই ক্লাসে মানুষ যায় কী করে?’

বোঝা গেল, তিনি এসব বিরক্তির মধ্য দিয়ে কিছু একটা প্রকাশ করতে চান। ট্রেনের যাত্রীদের কাছে এ ধরনের মানুষ চেনা বলে একজন মজা নিতেই বোধ হয় বলল, ‘ভাই মনে হয় সব সময় ফার্স্ট ক্লাস বা এসিতে চলেন।’

‘হ্যাঁ ভাই। এবার টিকিট পেলাম না। পাব কিভাবে, সব দুর্নীতিবাজ। সিন্ডিকেট করে টিকিট রেখে দেয়। কথা বলতে হবে। আমার এক এলাকার ছোট ভাই আছে, এখন মনে হয় রেলের উপমহাপরিচালক।’

‘দিন না ওনাকে একটা ফোন করে।’

‘করব। করব। এসব দুই নম্বরদের ঠেকাতে হবে।’

চা দিতে আসা বেয়ারাও একটা কড়া ধমক খেলো। কাপ এগিয়ে দেওয়ার মধ্যে যথেষ্ট বিনয় নেই বলে। ঘোষণা করলেন, উপ বা সহকারী মহাপরিচালক ছোট ভাইকে এ বিষয় জানিয়ে এরও একটা বিহিত করতে হবে।

এই সময় এলো টিকিট চেকার। তার কাছে টিকিট চাইতেই বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আরে রাখেন আপনার টিকিট। কোনো সার্ভিস নেই। আমি কথা বলব পরে আপনার সঙ্গে।’

‘তা না হয় বলবেন। কিন্তু টিকিট...’

‘এই সার্ভিসের আবার টিকিট।’

‘টিকিট দেখান।’

এখন মনে হচ্ছে ওর কাছে টিকিট নেই। জনতা মজা পেয়ে গেছে। একজন প্রায় নাক ডাকছিলেন, তিনি পর্যন্ত উঠে চোখ বড় বড় করে ঘটনা দেখছেন।

ভদ্রলোক এবার ভেঙে পড়ে বললেন, ‘আসলে তাড়াহুড়ায় উঠেছি তো। টিকিট কাটার সময় হয়নি।’

‘ফাইন দিন।’

সঙ্গে সঙ্গে কোরাস, ‘ফাইন দিন। মাল ছাড়ুন। ডাবল নেন।’ মানুষ তার কথায় এতক্ষণ এমন বিরক্ত ছিল যে টিটিইর চেয়ে ওরাই বেশি উদ্যোগী। লোকটি ফাইন দিলেন। সেটা নিয়ে টিটিই চলে গেলে বললেন, ‘আসলে বিষয়টা কি বুঝলেন, ফার্স্ট ক্লাস ছাড়া টিকিট কাটতে পারি না। ওই লাইনেই দাঁড়ানো যায় না।’

ঘুম থেকে ওঠা ভদ্রলোক প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, ‘চুপ, চট্টগ্রাম পর্যন্ত আর একটা কথা বললে ঘুষি খাবেন।’

ভদ্রলোক ঘুষি খাননি। চুপ করে ছিলেন।

ট্রেন মানে এ রকম বিচিত্র মানুষের সমাহারও। একটা চলন্ত জীবনব্যবস্থা। কিছু মানুষ রাতের ট্রেনে এমন নিশ্চিন্তে ঘুমায় যে দেখে মনে হয়, এটা ওদের বেডরুম। আর শুরুতেই তো মন ভালো হয়ে যায় নামগুলোর কারণে। পারাবত, এগারোসিন্ধুর, তূর্ণা নিশীথা, ঊর্মি গোধূলী। কী চমৎকার সব নাম। নাম দিয়ে মন জয় করার পর সৌন্দর্যের সম্ভার। পাহাড় চিরে বেরিয়ে যায় গভীর রাতে, কোথাও বিশাল নদী পেরোয় রাতের তারার সঙ্গে মিতালি করতে করতে। ভেসে থাকা জাহাজের আলো আর বিস্তীর্ণ জলরাশি মিলিয়ে সুন্দরের অফুরান স্রোত। সঙ্গে প্রায় শতভাগ নিরাপত্তা। কিন্তু ওই যে বললাম, ট্রেন অনেক দূরে দাঁড় করে রাখার মতো ছোট কিছু অসংগতি। এই যেমন প্রথম শ্রেণির সিট বলে যে টিকিটটা বিক্রি হয় সেটা দারুণ আরামদায়ক। দামেও সুলভ। কিন্তু টিকিটের সংখ্যা এত কম যে পাওয়া রীতিমতো লটারি জেতার মতো। আরো দু-একটা কেবিনের কামরা দিব্যি বাড়ানো যায়। এসব সামান্য সংস্কারে অসামান্য হয়ে উঠতে পারে জনবান্ধব এই যান। কিন্তু সেদিকে কি খুব মনোযোগ আছে! রেল যেন সত্মায়ের ছেলে। অবহেলা আর অনাদরই অমোঘ নিয়তি। ফেলে দেওয়া যায় না বলে কোনো রকমে টিকিয়ে রাখা আর কী!

যোগাযোগ আরামদায়ক। নিরাপত্তা প্রায় শতভাগ। ভাড়া সহনীয়। কিন্তু এসবও নয়, ট্রেনের তাৎপর্য বিস্তৃত বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রেও। খেয়াল করলে দেখবেন, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা কিংবা সহনশীলতায় অন্য শহরগুলোর চেয়ে এগিয়ে থাকে রেলের জংশনগুলো। যেসব জায়গায় রেলস্টেশন আছে, সেখানে চাকরির সুবাদে অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক মানুষ আসে। তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে স্থানীয়দের যোগাযোগে দুই পক্ষই সমৃদ্ধ হয়। আঞ্চলিকতা আর কূপমণ্ডূকতা অনেক কম থাকে সেসব জায়গায়। এখন অত গুরুত্বপূর্ণ নয় হয়তো, কিন্তু একসময় রেলওয়ে বুকস্টল হতো একটা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বই বা ম্যাগাজিনের দোকান। পাশেই ন্যায্য মূল্যে আবাসিক হোটেল, সারা রাত জেগে থাকা রেস্টুরেন্ট, মানুষের গমগম আওয়াজ। এখানকার পৃথিবী ঘুমায় না। বিশ্রাম নেয় না। এবং তারপর সেই রেলস্টেশন সেই মানুষেরও আশ্রয়, যার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বন্যায় ভেসে গেছে ঘর, মহাজন আশ্রয় কেড়ে নিয়েছে—এমন ছিন্নমূলরা নিশ্চিন্তে ঘর বাঁধতে চলে আসে স্টেশনে। সেই হিসাবে বাংলাদেশের রেলস্টেশনগুলো একটা এলাকার সবচেয়ে বড় আশ্রয়কেন্দ্রও।

অথচ কী দুঃখের কথা, সেই রেল আর ট্রেন আমাদের কাছে সত্মায়ের ছেলে!

 

লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক